কবে যেন কন্যা দিবস ছিল! চোখের সামনে ভাসছিল অনেক লেখা, ছবি! কোনো লেখা ছবিতেই মন ডোবাতে পারিনি। আমি মোটামুটি মিনিমাম ঘন্টা খানেক সময় নিয়ে রোজ যার যার পোস্ট সামনে এসে পড়ে শ্রেণীমত শুভকামনা দোয়া জানাতে থাকি।কোন দিবস এলেও বিরাট সাহিত্য লিখি।কিন্তু এবার এই কন্যাদিবসে আমার দম আটকে আসছিল!
আমরা মুসলমানরা জানি আল্লাহ যখন খুশি হন তখন রহমত হিসেবে কন্যা সন্তান, বৃষ্টি ও মেহমান দিতে থাকেন। আল্লাহর ইচ্ছায় আমি ও এই রহমতের অধিকারী হয়েছি আলহামদুলিল্লাহ।
তবে একটা কথা ভেবে দেখলাম খাঁচার পাখি যেমন খাঁচায় থাকে না তেমন এই রহমত রুপি কন্যারাও বাবা-মা কে দু:খের সাগরে ভাসিয়ে তার নিজের সংসারে চলে যায়।
ছোট বেলায় দেখেছি আম্মা নানাবাড়ি থেকে তিন মাইল দূরে দাদাবাড়ী যাবেন, শুরু হয়ে যায় নানীবুজির গোছানোর কাজ।নতুন কাঁথা থেকে শুরু করে বড় কাঠকচু, নারিকেল, গুড়ের হাঁড়ি,হেন কোন জিনিস নাই তিনি পোঁটলাতে বেঁধে দেননা! এই দেয়ার যেন শেষ নাই।বস্তা ভরে দেন,গুঁজে দেন,লুকিয়ে দেন আর পান মুখে দিয়ে কাঁদতে শুরু করেন। গরুর গাড়িওয়ালারা যতক্ষণ জোরে হাঁক না ছাড়ে আর নানাভাই যতক্ষণ রামধমক না দেন ততক্ষণ যে কোন উসিলায় আম্মা এবং নানীবুজি দুইজন কালক্ষেপন করতে থাকেন। এই কালক্ষেপণ প্রতিটি মা মেয়ের মধ্যে আবশ্যম্ভাবী এক ভালোবাসাময় গল্প।এই গল্পে কতটা মায়া ভালোবাসা জড়ানো থাকে তা শুধু মা আর মেয়েই জানে।যে মায়ের কন্যা নাই তারা এই গল্প বুঝবেন না।
আমার বাবার বাড়ি ঢাকায় হওয়ার আমি কখনো এই বিরহী অধ্যায় বুঝিনি।ছোট বয়সে বিয়ে হয়েছিল। এবং অবশ্যই আমি ভিষণ আহ্লাদী কন্যা। বিয়ের পরে পরে যখন মাশুক পেটে এলো তখন রাত-বিরেতে পা ছড়িয়ে ভ্যা ভ্যা কান্না জুড়তাম।আমার মহামানব শাশুড়ী মা ঘরে উঁকি দিয়ে বলতেন " ও মইনুল, কনক কান্দে কেন?" কান্নার কারণ শুনে তিনি বলতেন আহারে ছোট মানুষ, কান্দাইও না,যাও,মাদারটেক নিয়ে যাও!
এরপর হঠাৎ যেন আমি বড় হলাম।যখন তখন আর বাবার বাড়ি যাওয়ার জন্য কাঁদিনা!আর গানের ব্যাস্ততায় সেইসব আব্দার যাস্ট ভুলেই গেছি আজীবনের জন্য। এরপর আমার নিজের কোল জুড়ে একটা লাউ ফুলের মতো তুলতুলে গোলাপি গালের বারবি এলো। মনে আছে তাকে বুকে পাওয়ার পরে আনন্দে চিৎকার করে কেঁদে পুরো ফরিদা ক্লিনিক ভাসিয়েছিলাম।বিব্রত আব্বা, আম্মাকে বলেছিলেন তোমার মেয়েকে থামতে বল কারণ পাশের জন ভাবছে কন্যা হওয়ায় দু:খে কাঁদছি!
সেই ফারিয়া আমার পরিবারের মধ্যমনি হয়ে উঠলো। সারা বাড়ি তার দখলে। বাঘের মতো রাগী বাবাও তার কাছে নরম হয়ে যায়।আমি পুতুল খেলি ফারিয়াকে নিয়ে। নতুন নতুন ডিজাইনার জামায় কন্যা আমার একেকদিন একেক রকম হয়ে ওঠে।
আমার যেমন অল্প বয়সে বিয়ে হয়েছিল আমরাও তাকে অল্প বয়সেই বিয়ে দিলাম। যেন পুতুল খেলা। সত্যিই! একই পাড়ায় তার শ্বশুর বাড়ি।যখন তখন আসে, আমরা ও যখন তখন যাই।হঠাৎ বেড়াতে এসে হয়তো রাতে থেকে গেলো, দেখা গেল পুরো সপ্তাহই আমার বাসায় থেকে নাতি নাত্নিরা স্কুল করলো। তারা যখন তাদের নিজেদের আলাদা বাসা নিলো সেটাও দশ মিনিটের ড্রাইভ! এই ভাবে পনেরো বছর পার হলো।
এরমধ্যে অথবা ইদানীং আমি কখনো বিদেশ ট্যুরে গেলে ফারিয়া একটু অস্থির হতো। বলত আম্মু,তোমাকে ছাড়া ইদানীং ফাঁপড় লাগে! আমি বলি সারাজীবনই তো তোমাদের ছেড়ে কত লম্বা লম্বা সফর দিয়েছি।এখনো অভ্যস্ত হওনি!
মাশুক ও যখন তখন ফারিয়ার কাছে গিয়ে দম ফেলে। ভাই বোন কাজিন মামা সব মিলে তাদের একটা বন্ধুজগত ছিল, তাদের সবার মধ্যমনি ফারিয়া।জামাতা আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ ইয়াহইয়ারা আট ভাইবোন। তাদের ভাইবোন এবং তাদের বোনদের হাজব্যন্ড ও দেবরের বউ সবার প্রিয় আমার ফারিয়া আলহামদুলিল্লাহ !
সেই কন্যা আমার আজ এক বছর যাবৎ পুরো পরিবার নিয়ে অনেক দূরে! সংসার পেতেছে। কত গল্প কত কথা জমা কিন্তু ভিডিও কলে তা বলা হয়না, বলা যায় ভিডিও কলে দম আটকে আসে! নিজের লেজে পা না পড়লে আসল ব্যথা অনুভব হয়না এই কথা খুবই সত্যি ।আজ আমি বিস্ময় নিয়ে ভাবি রত্নাপা কিভাবে তাঁর একমাত্র কন্যা এ্যানিকে ছেড়ে হাসিমুখে দিন কাটান! আরও ভাবি আমার বউমা মারিনার মায়ের কথা। তিনিও তার কন্যাকে ছয় আট মাসে কাছে পান।বাচ্চার স্কুল মাশুকের অফিসের জন্য বাপের বাড়ি ঘনঘন যাওয়াই দায়! দেশের ভিতর থেকেও তার এই দু:খ!আমি তার দু:খেও দু:খি!
পৃথিবীতে কন্যারা কেনই বা এতো মায়া নিয়ে জন্মায়,কেনই দূরে যায়! পৃথিবীতে কেন এতো মায়া কেন এতো ভালোবাসা! আমি মোটামুটি অনুভব শুন্য। ফ্যাসিবাদিদের হাত থেকে মুক্তি পেয়েও কিছুই ভালো লাগেনা আমার । কিছুই না।
আল্লাহ, তুমি আমার ইয়াহইয়া ফারিয়া জুওয়াইরিয়া আমমার আর মোহাম্মদ কে অনেক ভালো রেখো।আর পৃথিবীর সব কন্যাদের মনে অনেক আনন্দ সুখ সম্বৃদ্ধি দিও আল্লাহ।